সুন্দরবনে যাওয়ার ইচ্ছে জেগেছিলো আগে থেকেই যখন বিটপা কনফারেন্সে খুলনা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত করোনার কারনে বিটপা স্থগিত হওয়ায় আর যাওয়া ও হয়নি। তাই একটা ফ্রেন্ডের বিয়েতে যখন খুলনা গেলাম, তাই সুন্দবরবন ঘুরা মিস করিনি। শুধু কনফিউশনে ছিলাম এক দিনের জন্য যাবো নাকি প্যাকেজে কোনো এজেন্সির সাথে যাবো।
দুইদিন আগে আমরা খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ঘাটে গিয়ে সরাসরি কথা বলে ”সুন্দরবন পলি ট্যুরিজম” এজেন্সির মাধ্যমে প্যাকেজেই গিয়েছিলাম। ৭ হাজার টাকার প্যাকেজ ছিলো। কিন্তু যেহেতু আমরা সিলেট থেকে গিয়েছি। তাই ১ হাজার টাকা কমে ৬ হাজার টাকা করে রেখেছিলো। প্যাকেজের প্রাইসটা মূলত ডিপেন্ড করে জাহাজের উপরে। প্রিমিয়াম কোয়ালিটির জাহাজে গেলে প্রাইস আরো বেশি লাগবেই।
প্যাকেজটা ছিলো মূলত ৩ দিন ২ রাত। এই ৩ দিন ২ রাত সময়টা সম্পূর্ণ তাদের দায়িত্বে। থাকা খাওয়া ধরে সবকিছুই ছিলো শিপের মধ্যেই। তাদের প্যাকেজ অনুযায়ী আমাদেরকে মূলত ৬ টা প্লেসে নিয়ে যাবে। আমরা ছিলাম দুইজন। আর সর্বমোট প্রায় ৩০-৪০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে তারা সকাল ১১ টার দিকে ছোটে চললো সুন্দরবনের দিকে…
হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রঃ-
☛ সুন্দরবনে যেহেতু আমরা টুরিস্ট এজেন্সি এর সাথে গিয়েছিলাম। তাই ১ম দিনে আমাদের ঘুরে দেখার জন্য শুধুমাত্র একটা স্পট ছিলো। আর সেটা হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। খুলনা থেকে হাড়বাড়িয়া যেতে যেতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিলো।
☛ হাড়বাড়িয়ায় প্রবেশ পথেই ছোট্ট ব্রীজ পাড় হলেই সামনে ”হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র” এর সাইনবোর্ডটা। তার সামনে বড় মাঠের পাশেই মসজিদ। মাঠের পশ্চিম দিকে আবার বসার মতো অনেক জায়গা। যেখান থেকে সহজেই সুর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। মাঠ পাড় হলেই ঝুলন্ত ব্রীজ। যদিও সেতুটা তখন পানি বিহীন ছিলো।
☛ ঝুলন্ত সেতু পাড় হয়ে সামনে গেলেই পাওয়া যায় বিশাল আকৃতির পদ্মপুকুর। ভাগ্য ভালো থাকায় প্রথম দিনেই বন্য বানর, হরিণ ও কুমিরের দেখা পেয়ে গেলাম সেখানেই। যদিও আগে চিড়িয়াখানায় দেখেছি। কিন্তু বন্য হরিন ও কুমির এই প্রথম দেখেছি।
☛ তারপর আবার সবার সাথে হাঁটা শুরু করলে সামনে ওয়াচ টাওয়ার ও বিভিন্ন ভিডিওতে ও ছবিতে দেখা বনের মধ্যে দিয়ে কাঠের রাস্তাটা বা ফুট ট্রেইল পেলাম। যদিও আমার ছোটকাল থেকেই কাঠের ব্রীজে হাটার এক্সপেরিয়েন্স আছে। কারন আগে আমার বাড়ির সামনেই কাঠ ও বাশের ব্রীজ ছিলো। কিন্তু বনের মধ্যে দিয়ে হাটার অনুভূতিটা একটু অন্যরকম। এতো গভীর বনের মধ্যে ঘুরতে গিয়ে মনের মধ্যে একটা ফিলিংস কাজ করতে যে এই বুঝি বাঘের দেখা পেতে যাচ্ছি। তাছাড়া ওয়াচ টাওয়ার থেকে শুনতাম পুরো হাড়বাড়িয়া দেখা যায়। কিন্তু মিথ্যা কথা। যেদিকে চোখ যায় শুধু নানান প্রজাতির গাছ আর গাছ।
☛ যাই হোক, ফুট ট্রেইল বনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবার পুকুরের অন্য পাশ দিয়ে বের হলাম। আবার ও সেই বাচ্ছা হরিনের দেখা পেলাম। বেচারা পানি খেতে আসছিলো। কিন্তু মানুষের নাড়াচাড়ায় ভয়ে দৌড় দিয়েছে।
☛ এই ট্যুরে আমিও রজব ভাই ছাড়া বাকি সবার ছিলো ফ্যামিলি ট্যুর। তাই ট্যুরটা আমার কাছে একটু বেশিই ভালো লেগেছে। কারন আমার মতো আরো ৫-১০ টা পুলাপাইন সাথে থাকলে সবার চিল্লাচিল্লি আর হৈ হুল্লোরে না পারতাম ঠিকমতো ঘুমাতে, না পারতাম ঠিকমতো উপভোগ করতে। কারন সুন্দরবন টা হচ্ছে নিরিবিলি ঘুরাঘুরির জন্য উপযোগ্য একটা জায়গা। ধুলোবালির শহরের থেকে একদম ভিন্ন সুন্দরবনের পরিবেশ।
☛ যেহেতু প্রথমবারের মতো গিয়েছি, আমার কাছে মোটেও খারাপ লাগেনি। আরো অনেক জায়গায় ট্যুর দিয়েছি। কিন্তু দুই তিন দিন চলে গেলে একটা সময় বোরিং লাগা কাজ করে। কিন্তু সুন্দরবনে ও জাহাজে কাটানো একটা মুহুর্তও বোরিং লাগে নি। বরং সুযোগ পেলে আরো যাবো ইনশা আল্লাহ।
যাই হোক। আমরা আবার জাহাজে ফিরে আসলাম। আর সুর্যাস্ত হতে হতে শুরু হলো পরবর্তী স্পটের জন্য যাত্রা…



জামতলা সী বীচঃ-
সুন্দরবনে আমাদের ২য় দিনের টাস্ক ছিলো টোটাল ৪টা স্পট ঘুরে দেখা। ১ম স্পট হলো জামতলা সী বীচ। যেখান থেকে আমরা সুর্যদয় দেখবো। যেখানে প্রায় দিন ভোরের পরেই ঘুমাতে যাই। সেখানে ভোরে উঠা কষ্টের ছিলো। কিন্তু বললামই তো, আমি আর রজব ভাই ছাড়া সবার ফ্যামিলি ট্যুর। তাই কোনো হৈ হুল্লোড় নাই। রাতে নিরিবিলি ঘুম দিয়ে গাইডের কথামতো খুব ভোরে উঠে আমরা ট্রলারে কর চলে যাই আমরা জামতলা সি বীচের উদ্দেশ্যে।
☛ ট্রলার থেকে নেমে বীচ পর্যন্ত যাওয়া-আসা প্রায় ৭ কিলোমিটার। কিন্তু আমার জন্য ব্যাপার না। হাঁটার কোনো টাস্ক হলে সেটা আরো আনন্দের সাথে গ্রহন করি। কিন্তু ভয় একটা। বনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হবে, যেখানে কোনো জনমানবের চিহ্ন নাই। জাস্ট ট্রলারে যেই ৩০-৩৫ জন ছিলাম তারাই। যদি বাঘ এসে সামনে বসে থাকে!! যদিও গাইড ও নিরাপত্তারক্ষী সাথে ছিলো।
☛ যাই হোক। হাঁটতে হাঁটতে আবার পেলাম বন্য বানর, অনেকগুলো হরিনের দেখা। আমি তো ছবি তুলতে ব্যস্ত। কারন এটা আমার নেশা! বনের ভিতর দিয়ে ঘাস ও বালুর রাস্তা হয়ে চলে গেলাম আমরা জামতলা সী বীচ পয়েন্টে। যেখানে এক পাশে সুন্দরবন আর অন্য পাশে বঙ্গোপসাগর। আমরা সেখানে পৌঁছার আগে আরেকটা জাহাজের পর্যটকরা পৌঁছে গেছে। আর আমরা থাকা অবস্থায় ও পরে আরো অনেকেই আসছে!
☛ যেহেতু কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন ঘুরেছি কয়েকবার। তাই সাগরের প্রতি তেমন একটা ভালো লাগা কাজ করেনি। কিন্তু সুন্দরবনটা আসলেই অনেক সুন্দর। আমার মায়া হয় গাছগুলোর জন্য। কারন গাছগুলো ভেঙ্গে পরে পচে মাটির সাথে মিশে যায়। অথচ আমাদের এদিকে হলে মানুষ লাকড়ি করে জ্বালাতো।
☛ যাইহোক, সূর্যদয় দেখে দেখে কিছু ফটোস্যুট করে আমরা চলে আসছি। কারন আমাদের পরবর্তী স্পট টা হলো সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষনীয় টুরিস্ট স্পট! অনুমান করেন তো কি হতে পারে…



কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রঃ-
সুন্দরবনে আমাদের ২য় দিনের ২য় স্পট ছিলো ”কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র”। সুন্দরবনের প্রতিটি টুরিস্ট স্পটের মধ্যে কটকা অন্যতম। আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। বলতে পারেন সুন্দরবনের প্রতিটি স্পটের মধ্যে কটকা অলরাউন্ডার। কারন এখানে সমুদ্র সৈকত থেকে সুর্যদয়, সুর্যাস্ত খুব সহজে উপভোগ করা যায়। আছে কাঠের ট্রেইল ও ওয়াচ টাওয়ার সহ অনেক কিছু।
কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিলো এখানে একসাথে বন্য হরিনের দল দেখা যায়। সকালবেলা তারা দল বেধে গাছের পাতা খেতে আসে। তাছাড়া এখানে সকালবেলা ছবি তুললে জোস একটা ব্যাকগ্রাউন্ড পাওয়া যায়।



হিরন পয়েন্টঃ-
কটকা দেখে আবার ৪-৫ ঘন্টার লম্বা জাহাজ জার্নিতে আমরা ছুটে চললাম হিরন পয়েন্ট দেখতে। এর আরেক নাম নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্র। এখানে পাশেই মূলত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাটি স্থাপন করা হয়েছে। আগের ৩টা প্লেসে বাঘের দেখা না পেলেও অবশেষে হিরন পয়েন্টে প্রবেশ করতেই সামনে দুইটা বাঘ ও একটা হরিন দেখলাম। যদিও এগুলো ইট পাথরের তৈরী।
এখানে মূল আকর্ষন হচ্ছে পুকুরের পাশে সারি সারি নারিকেল গাছ। এর বাইরে আমার কাছে খুব একটা ভালো লাগে নি। তবে ছোটবেলা থেকে বইয়ের পাতায় পড়ে আসা সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের দেখাও পেয়েছি হিরন পয়েন্টে। তাছাড়া নানান পশুপাখি তো আছেই…



দুবলার চরঃ-
সুন্দরবনে আমাদের ২য় দিনের ৪র্থ ও শেষ প্লেস ছিলো “দুবলার চর”। দুবলার চর মূলত জেলেদের গ্রাম। মাছ ধরার পাশাপাশি শুটকি শোকানের কাজ চলে সেখানে।
সুন্দরবন যাওয়ার আগে যখন দুবলার চরের ভিডিও দেখি তখনই এখানকার প্রতি আলাদা একটা আকর্ষন তৈরী হয়। কারন শুটকি কিনবো! তাছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে দুবলার চরই একমাত্র জায়গা যেখানে বাজার আছে। অনেকটা সেন্ট মার্টিনের মতো চারিদিকে পানি ও মাঝে চর হলেও এখানে বছরের মাত্র ৪ মাস জেলারা বসবাস করতে পারে…
এখানে সাগরে গোসল করে বাজার ঘুরে দেখলাম। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই এখানে আছে। আমি শুটকি কিনলাম আর সাথে কিছু জিলাপি। হুম, দিনটা ছিলো ১ মার্চ। আমার বার্থডে, যেহেতু এটা ওতো বড় বাজার না। তাই জিলাপী’ই ছিলো ভরসা। বার্থডে উপলক্ষে আমার পক্ষ থেকে জাহাজের সবাইকে জিলাপি খাওয়ালাম। দুবলার চর থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আজকের রাত জাহাজ মুটামুটি রানিং এর উপরেই থাকবে। কারণ এখন ব্যাক করার পালা। তাই জাহাজ ছুটে চললো আবার মংলার দিকে।



করমজল পর্যটন কেন্দ্রঃ-
সুন্দরবনে এটা ছিলো আমাদের সর্বশেষ প্লেস। নাম “করমজল পর্যটন কেন্দ্র”। এটা মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে কাছেই। যারা একদিনে সুন্দরবন ভ্রমন করে তারা মূলত করমজলেই ঘুরতে যায়। এখানে কুমির, হরিন, বানর সহ রয়েছে নানান প্রজাতির পশুপাখি।
সকালে কাঠের ট্রেইল ধরে যখন হাটছিলাম। পাখিদের কুহুকুহু শব্দগুলো আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাটতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম সুন্দরবনের সৌন্দর্যে।
সুন্দরবনে বাঘ ও বাঘের পায়ের ছাপ না দেখলেও করমজলে এসে বাঘের পাগমার্ক, কুমিরের ডিম ইত্যাদির দেখা পেয়েছি। তবে ওয়াচ টাওয়ারে উঠতে পারিনি। কারন সেখানে মৌচাকের বাসা ছিলো।



ইট পাথর ও ধুলো বালির শহর থেকে সুন্দরবন কতটা ভিন্ন সেটা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। আর সুন্দরবন ঘুরে দেখে যদি আপনার কাছে ভালো না ও লাগে, কিন্তু জাহাজের খাবার গুলো অনেক স্বাদ। তাদের খাবারগুলো কখনো ভুলার মতো না। আর খাবারে প্রতিবেলায় থাকতো নতুন কিছু। আর ২য় রাতে ছিলো বারবিকিউ। তাছাড়া জাহাজের স্টাফ যারা, তাদের ব্যবহার খুবই ভালো। সবাই অনেক ফ্রেন্ডলি।
সবকিছু মিলিয়ে সুন্দরবন ভুলবো না। খুলনা গেলে সুন্দরবন মিস করবো না ইনশা আল্লাহ….

















